আমি প্রেমে পড়েছি।
এটা কোনো হাস্য রসাত্নক কথা নয়। কাজেই প্রিয় পাঠক, লাইনটি পড়ে চট করে হেসে উঠবেন না। মিথ্যেমিথ্যি প্রেমে পড়ার মধ্যে এক ধরণের রস আছে বটে। কিন্তু যে প্রেম সত্যিকারের, সেটার অভিজ্ঞতা খুব সুখতব্য নহে। আমার গোটা মন এবং হৃদয় অকারণ বিষাদে ছেয়ে আছে। বুকের খুব ভেতরের কোনো এক অচেনা জায়গায় খেলা করছে এক খন্ড হাহাকার। যে হাহাকারের জন্ম এই পৃথিবীতে নয়, অন্য কোথাও, অন্যত্র।
প্রেমে পড়ার আরেকটি বিপদ হচ্ছে, যার প্রেমে পড়েছি, তিনি সেটা জানেন না। আরও বিপদ, তার সাথে আমার সামনাসামনি কখনো দেখাই হয়নি। কাজেই তিনি আমাকে চেনেনও না।
এ পৃথিবীতে আজ অবধি যত লোক প্রেমে পড়েছে এবং ভবিষ্যতে যত যুবা প্রেমে পড়বে, তাদের প্রত্যেকের একটি কমন সমস্যা রয়েছে। তারা তাদের প্রেমের কথা মনের মানুষকে জানাতে ভয় পান। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে এই সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি সেলিব্রেটি মানুষ ছিলেন। কাজেই মুখ ফুটে প্রেমের কথা বলা তার জন্য সমীচীন ছিল না, নিরাপদও ছিল না।। প্রেম মানুষকে মুখচোরা করে, সেলিব্রেটিদের করে বোবা। তাকেও করেছিলো। অবশ্য যেকোনো সংকটকে শিল্পের কাঁচামাল বানিয়ে ফেলতে তিনি পটু ছিলেন। যন্ত্রণা কাতর মুক রবীন্দ্রনাথ মুখর গীতিকার হয়ে লিখেছিলেন, আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইলো না কেহ। খুবই বিখ্যাত গান!!
আমি রবীন্দ্রনাথ নই। কাজেই আমার পক্ষে গান ফেঁদে বসা সম্ভব নয়। অত মেধা এবং ধৈর্য্য আমার নেই। আমার আছে কেবল যন্ত্রণা। তবে জীবনের অপরাপর যন্ত্রণার সাথে প্রেমের যন্ত্রণার একটা মস্ত অমিল আছে। সর্বপ্রকার যন্ত্রণায় মানুষ ভোগে। কেবল ‘’ভালবাসার’’ যাতনা মানুষকে ভোগায় না, মানুষ এটা উপভোগ করে। এটা এক ধরণের ব্যথা, তবে সুখের মতো ব্যথা। জ্বী, এই বিশেষ ব্যথায় চোরা কাঁটার মতো সুখ লুকিয়ে থাকে। আমি চাপা পিটাচ্ছি না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এ ব্যথাকে স্বীকৃতি দিয়ে লিখেছেন, বুকে বাজিল ''সুখের মতো ব্যথা''।
এই ব্যথা আমাকে খুব (উপ)ভোগাচ্ছে। আমি প্রেজেনটেশন দিতে গিয়ে স্লাইড উল্টাপাল্টা করে ফেলছি, জনসম্মুখে আমাকে নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে। বন্ধুদের তুমুল আড্ডায় আমি অন্যমনস্ক হয়ে উঠে গিয়ে সিগারেট টানছি। বহুক্ষণ সিগারেট ফোকার পরও সিগারেট শেষ হচ্ছে না, তখন আবিষ্কার করছি, সিগারেটে আগুণ জ্বালাতে ভুলে গেছি। পকেট থেকে লাইটার বের করে সিগারেট জ্বালাবো, নাকি হৃদয়ের আগুনে এটাকে পোড়াবো, দ্বিধায় ভুগছি।
মাঝে মাঝেই খুবই পানির তৃষ্ণা পাচ্ছে। পানি খাবার সময় মনে হচ্ছে বিষ পান করছি, জেনে শুনে। বিছানায় শোয়ার পর চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে যাচ্ছে। আবার উঠে বসলে ঘুমে মরে যাচ্ছি।
এ সবকিছুই উচ্চমাত্রার প্রেমের লক্ষণ।
মানুষ তিনটি মাত্রায় প্রেমে পড়ে। প্রথম মাত্রার প্রেম ততটা বিপদজনক নয়। অনেকটা কাঁদায় পা পিছলে পড়ে যাওয়ার মতো। সামান্য ব্যথা পাবেন, গায়ে বড়জোর কাঁদা-ময়লা লাগবে। কিন্তু বাসায় গিয়ে ঝেড়ে গোসল দিলেই ব্যাপারটা শেষ।
দ্বিতীয় মাত্রার প্রেমটি একটু বিপদজনক। কলার খোসায় পা হড়কে চিৎ হয়ে পড়ে যাবার মতো। ব্যথা তো লাগবেই, বিধি খারাপ হলে কোমর ভাঙতে পারে।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে তৃতীয় মাত্রার প্রেমে পতন। আপনি উড়ন্ত প্লেন থেকে বেশ বাহাদুরের মতো ঝাঁপ দিলেন। তারপরেই আপনার মনে হলো, এই রে, প্যারাসুট বাঁধতে ভুলে গেছি। আপনি পড়ছেন তো পড়ছেন, এই পতনের কোনো শেষ নেই। আপনার হৃদয় তুমুল উত্তেজনায় খান খান হয়ে যাচ্ছে। আতংকে শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। হৃৎপিন্ড চলে এসেছে গলার কাছে। বাঁচার উপায় যেমন নেই, তেমনি পুরো সিন শেষ না হওয়া পর্যন্ত মরার উপায়ও নেই। ইহাই তৃতীয় মাত্রার প্রেম।
আমি তৃতীয় মাত্রার প্রেমে পড়েছি।
আমি যেমন রবীন্দ্রনাথের মতো কবি নই, তার মতো সেলিব্রেটিও নই। আমার মেধাও নেই, হারানোর মতো মান সন্মানও নেই। কাজেই প্রেমের কথা কইতে আমার ডর কীসের।
রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া। সিরিয়াসলি, উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, এই লাইনের সহি হিন্দি অনুবাদ এটাই।
কাজেই আমি বলবোই।
যার প্রেমে পড়েছি, তাকে আমি তো চিনিই, এমনকি আপনারাও চেনেন। কেননা তিনি টিভিতে নাটক করেন। না চেনার কোনো কারণ নেই। আমিও তাকে ম্যালা দিন হলো টিভিতে দেখা সূত্রেই চিনতাম, কিন্তু তিনি আমাকে চিনতেন না। কেননা টেলিভিশনের অনেক সীমাবদ্ধতার একটি হলো, আপনি টিভিতে সুচিত্রা সেনকে দেখতে পারবেন, কিন্তু তিনি আপনাকে দেখতে পারবেন না। পুরো একচোখা মিডিয়া। যাই হোক, তাকে টিভিতে দেখতাম, কিন্তু কদ্যপি তার জন্য কণামাত্র যাতনা বোধ করিনি। কেননা আমাদের টিভি নাটকে থাকে নাটকীয়তা। আর এর অভিনেত্রীরা হয়ে যান নাটকের পুরো দস্তুর নায়িকা। তারা পার্কের গাছে ঝুলে গানে টান মারেন। অতিরিক্ত হাসেন, মাত্রাতিরিক্ত কথা বলেন এবং অতিমাত্রাতিরিক্ত ঢং করেন। সত্যি কথা বলতে কি, এসব দেখে মজা লাগে বটে। কিন্তু এদের রক্ত মাংসের মানুষ বলে ঠিক মনে হয় না। কেবলই মনে হয় এরা ভিনগ্রহের কোনো এলিয়েন, বাংলা নাটক নামক সায়েন্স ফিকশনে অভিনয় করছেন। কিন্তু এই অভিনেত্রীর একটি নাটকে অভিনয় করলেন, যে নাটকে কোনো নাটুকেপনা ছিল না। তিনি নাচেননি, কাঁদেন নি, হেসে কথা কন নি, এমনকি কটাক্ষে তাকানও নি। তিনি ঠিক পাশের বাড়ির মেয়েটির মতো আলতো করে হেঁটেছেন, নির্ভার কথা বলেছেন।
গল্পটার মধ্যে এত স্বাভাবিকতা ছিল, এটাকে আমি গল্প বলে মানতে নারাজ। এটি ঠিক গল্প নয়, পাশের বাসার কোনো ঘটনা। এতে লা রে লাপ্পা মাস্তি নেই, যাত্রাদলের টান টান উত্তেজনাও নেই। কোনো মশলা নেই, সস নেই, কোল ড্রিংকসের ঝাঁজ নেই। এত কিছু নেইয়ের ভেতর কি যেন আছে, আমার দেখে এত ভালো লাগলো। এত ভালো লাগলো। এত মিষ্টি লাগলো। এত বুক ভরে গেলো। পুরো ব্যাপারটা এত আটপৌরে ভাবে ঘটে গেলো! কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য।
আমি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেলাম। যতবার নাটকটি দেখছি, ততবার মেয়েটিকে দেখে আমার বুক কাঁপছে।
আহসান হাবীবের দোতলায় ল্যান্ডিং কবিতার আদলে বানানো '' কথা হবে তো? '' নাটকটি, এর নির্ভার গল্পটি, এর সাধাসিধে সিঁড়িটি এবং সেথায় দাঁড়িয়ে থাকা আরও সাদাসিধে মেয়েটি আমাকে বেশ কিছুদিন আচ্ছন্ন রাখবে। সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে মেয়েটি। মনে হচ্ছে, সে পাশের বাসায়ই আছে। একটু গান খাড়া করলে তার গলা শোনা যাবে। কোনোদিন আচমকা সিঁড়িতে দেখাও হয়ে যেতে পারে।
দেখা হলে, তাকে কথাটি বলবোই।
আমি অপেক্ষায় আছি। অপেক্ষা করতে আমার ভালোই লাগছে। আবার ভালো লাগছেও না।