ছেলেদের একান্ত ''গুপন'' কিছু কষ্ট থাকে, যে কষ্টের খবর মেয়েরা তো দূরের কথা, সমাজের অন্য ছেলেরাও ঠিক মতো জানে না।
সেদিন এক বন্ধুর বাসায় গেছি। বন্ধুর একটি ছেলে আছে, ভীষণ চঞ্চল। গিয়ে দেখি বেচারা বেশ শান্তশিষ্ট হয়ে বসে আছে। দুষ্টমির দ-ও নেই। কারণ কি?
পিচ্চিটার ''সুন্নতে খাতনা'' হয়েছে। শুনে আমার নিজের শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। কষ্টে বুকের ভেতর এবং শরীরের আরেকটি বিশেষ জায়গা টন টন করে উঠলো।
আমার মনে পড়ে, ছেলেবেলায় বাসায় যখন সিদ্ধান্ত নেয়া হল আমার খাতনা হবে শুনে আমি কেঁদে ফেললাম। বললাম, না, না, না, কিছুতেই না।
আমাকে কনভিন্স করাতে এগিয়ে এলেন আমার বড় মামা। বললেন, ছেলে হয়ে যখন জন্মেছিস, তখন ...
মামা কথা শেষ করতে পারলেন না। নিজেই ঝর ঝর করে কেঁদে দিলেন। খুব সম্ভবত তারও শৈশবের কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো। তারও খুব সম্ভবত বুক এবং শরীরের অন্যত্র বিশেষ জায়গা টন টন করে উঠেছিলো।
জীবনে ওই প্রথম ছেলে হওয়ার জন্য নিজেকে অভিশাপ দিলাম।
শুভক্ষণ দেখে দিনক্ষণ ঠিক করা হলো। দেখতে দেখতে সেই ভয়ংকর দিন এসে উপস্থিত হলো। আমি ভয়ে নাওয়া খাওয়া ছেড়েই দিয়েছিলাম। শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেলাম।
তখন হাসপাতালে নিয়ে কাটাকাটি করার আরামপ্রদ এবং সভ্য নিয়মটি চালু হয়নি। এই মহান কাজের জন্য বিশেষ একজন থাকতেন, তাকে বলা হতো হাজাম। আমার ''কাজ'' করার জন্য একজন বিশিষ্ট দশাসই হাজাম ঠিক করা হলো।
বাসা ভর্তি লোক। দুনিয়ার আত্নীয়স্বজন এসে হাজির। দুভাগ্যক্রমে আত্নীয়স্বজনদের মধ্যে আত্নীয়াদের সংখ্যাই বেশি। চাচাতো, মামাতো ভাইদের আসতে নিষেধ করে দেয়া হল। কেননা তারা যদি দেখে ভয় পায়। বোনদের জন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় বোন, বোনের বান্ধবীকুল ... সে এক মহাসমাবেশ। সকলের সেকি কৌতুহল!!!
হাজাম আসলেন দুপুরে। এই উপলক্ষ্যে আমাকে লুঙ্গি পড়ানো হলো। লাল, অভিশপ্ত বেদনাবহুল সেই লুঙ্গির ডিজাইন আজও আমার মনে আছে।
আমাকে বসানো হলো একটা জলচৌকিতে। বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে হাজাম বলল, এই পুলা লুঙ্গি খুল।
সাথে সাথে চারিদিক থেকে উৎসাহী লোকজন লুঙি খুলে দিল। এ যেন দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ। আমি নাঙ্গা বাবা হয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। কেউ বসতেও বললো না।
এরপর লাগলো ক্যাঁচাল। বড় মামা এবং হাজামের মধ্যে খুবই তুচ্ছ একটি বিষয় নিয়ে তর্ক বেঁধে গেলো। তাদের কথা আর শেষই হয় না। আমি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে। গায়ে কোনো সূতা নেই, চারিদিকে গ্যালারির মতো মানুষ, তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে আমার মনে হলো, আমি একা, বড় একা এবং বড় বেকায়দা লেভেলের একা।
যাক, পরবর্তী বিভৎস্য, রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব না। কাজী আনোয়ার হোসেনের মতো থ্রিলার লেখার হাত আমার নেই।
আমার শুধু মনে আছে এই ঘটনার পর আমাকে দীর্ঘদিন লুঙ্গি পড়ে থাকতে হয়েছিলো। শুধু তাই নয়, লুঙ্গির একটি বিশেষ জায়গা উচু করে ধরে রাখতে হতো। ঘা শুকানোর জন্য ''মডেমের'' মাথায় বদনা দিয়ে গরম পানি ঢালার উঞ্চ এবং বেদনাদায়ক স্মৃতিও ভোলার নয়। এ কভু যাবে না ভোলা।
আরো কষ্টের বিষয় কি জানেন? আমি তো এখানে প্রমিত ভাষায় বলছি 'সুন্নতে খাতনা' । আমাদের এলাকায় এই মহান অনুষ্ঠানের নাম ছিল ''চ্যাং কাটা''।
এই কাজে কষ্ট আছে, কোনো সন্মান নেই, কোনো স্বীকৃতি নেই।
ছেলেদের এই দুঃখের কথা কয়টা মানুষ জানে?