ক্ষণিকা

বোকা ছেলেটা'র গল্প

বোকা ছেলেটা'র গল্প

কুড়ি বছর আগের কথা।

আমার চাচা চিটাগাং যাবেন। রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে আছেন। ট্রেন যথারীতি লেট। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে গাদাগাদি ভীড়। চাচার পাশে বসে আছেন এক তরুণ।

বয়স্ক মানুষরা কথা বলতে ভালোবাসেন। আমার চাচাও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি সেই পাশের তরুণটির সাথে গল্প জমানোর চেষ্টা করলেন।

তরুণটি বেকার। চাকরি বাকরি নেই। তার বাড়ি চিটাগাং। ঢাকায় এসেছিলো জীবিকার সন্ধানে। কোনো সুবিধা করতে পারেনি। হাল ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। ছেলেটি যথেষ্ট শিক্ষিত। এমএ পাশ। কথাবার্তায়ও দারুন স্মার্ট। এই রকম শিক্ষিত, মার্জিত এবং ভদ্র ছেলেটি এতদিনে কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেনি- এটা দেখে আমার চাচা খুবই বিস্মিত হলেন।

কথা বার্তার এক পর্যায়ে চাচা বললেন, বাবা কিছু মনে করো না। আমি একটু বাথরুমে যাবো। তুমি আমার ব্যাগটা একটু দেখো।

ছেলেটি হেসে বললো, কোনো সমস্যা নেই চাচাজি। আপনি টয়লেটে যান।আমি আছি।

টয়লেট সেরে এসে চাচা দেখলেন, ছেলেটিও নেই, ব্যাগটিও হাওয়া।

আমার চাচা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। এই রকম পরিস্থিতিতে যা হয়- তাই হলো। আশেপাশে প্রচুর মানুষ জড়ো হলো। সবাই চাচাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলো। চাচার মতো বোকা মানুষ তারা আর একটিও দেখেনি।

আমার চাচা মনে মনে শপথ করলেন, জীবনে আর কোনোদিন কাউকে বিশ্বাস করবেন না।

এই শপথ করার সাথে সাথে এক কান্ড হলো। চাচা দেখলেন, সেই ছেলেটি দৌড়ে এসে ওয়েটিংরুমে ঢুকলো। তার কাঁধে চাচার ব্যাগ।

কী ব্যাপার?

চাচা যখন বাথরুমে ছিলেন, তখন ট্রেন এসে গিয়েছিলো। ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠে সিট রেখে এসেছে।। নিজের জন্য কোনো সিট সে  ম্যানেজ করতে পারেনি, তবে প্রাণপণ চেষ্টায় আমার চাচার জন্য একটা সিট ম্যানেজ করেছে। নিজের ব্যাগটি সেই সিটে রেখে এসেছে - সিটের দখলটি যাতে হাতছাড়া না হয়।

আমার চাচা কাঁদতে কাঁদতে তওবা করলেন। জীবনে আর কোনোদিন মানুষকে অবিশ্বাস করবেন না।

এই ঘটনাটি যখন চাচা আমাকে বলেন, তখন তিনি কাঁদছিলেন।

আমি সেই ছেলেটির কথা ভাবি। বিশ বছর আগে সে বেকার ছিলো। আমি নিশ্চিত- আজও ছেলেটি বেকারই আছে।

চাকরি দেবার সময় আমরা দেখি, চাকুরি প্রার্থী চাঁদের ওজন জানে কিনা। উগান্ডার মুদ্রা নাম কি- সেটা মুখস্থ কিনা। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কয় মাইল কিংবা সিরাজ উদ দৌলা কত সালে জন্মেছিলেন, সেটি তার মনে আছে কিনা।

এর ফলও অামরা হাতে নাতে পাচ্ছি। কয়লা থেকে স্বর্ণ-সবই চুরি হয়ে যাচ্ছে। চুরি হবার পর আমরা অবলীলায় বলছি, ওজন মাপার মেশিনে ভুল ছিলো। ৪ লিখতে গিয়ে ভুল করে ৮ লিখেছি। এই কথাগুলো বলার সময় আমাদের একটুও লজ্জা লাগছে না।

যে মানুষটি সৎ- তাকে আমরা বলি বোকা। আর যে মানুষটি ঘুষ খেয়ে পেট মোটা করে ফেলেছে, তাকে বলি, হুমম, উনি বিরাট অফিসার।

এই হচ্ছে আমাদের বাঙালি সমাজ।

এই সমাজে বোকা ছেলেটা গত বিশ বছর ধরে অন্যের ব্যাগ নিয়ে দৌড়াচ্ছে। এই সমাজে তার কোনো গন্তব্য নেই। হায়!