ঘরটা অনেক বড়। মশার কয়েল ঘরের কোণে রাখার নিয়ম। কিন্তু সন্ধ্যা বেলায় মশার কয়েলটা জ্বালিয়ে ঠিক নিজের পায়ের কাছে এনে রাখলেন বাবা। এরপর বেশ যত্ন করে খবরের কাগজ মেলে ধরলেন। তার আগ্রহ দেখে কে বলবে, এটা দুই দিনের বাসি খবরের কাগজ। অফিস থেকে না বলে নিয়ে আসা।
মশার কয়েল পুড়ছে। আর তিনি এমন অখন্ড মনোযোগের সাথে পড়ছেন, মনে হচ্ছে, কাগজটা একটু আগেই বের হয়েছে। এতে অতীতের খবর তো বটেই এমনকি ভবিষ্যতের কিছু এক্সক্লুসিভ খবর দেয়া আছে। যেটা এক্ষুণি পড়ে না ফেলতে পারলে মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে।
আমরা দুই ভাই মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে পড়তে বসেছি। দুইজন তাল মিলিয়ে বেশ জোরে জোরে পড়ছি, ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। জোরে পড়ার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। বাবা এবং পাড়াপ্রতিবেশী সবাই যাতে বোঝে, আমরা লেখাপড়ার ব্যাপারে অত্যন্ত সিরিয়াস।
আমাদের পড়ার শব্দে বাবা খানিকটা বিরক্ত হলেন। খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে বললেন, বলতো ঢাকা কোথায়?
আমরা থতমত খেয়ে গেলাম। এটা তো বইতে লেখা নেই। কি মুসিবত।
বাবা ক্ষেপে উঠলেন, গাধার দল। এতক্ষণ কি পড়ছিস। ঢাকা বুড়িগঙ্গার পাশে। পড়া যদি মাথায় না ঢুকে, তাহলে পড়িস কেন?
আমরা দুটি ভাই দুজনের দিকে তাকাই। ও আচ্ছা, ''অবস্থিত'' মানে হচ্ছে ''থাকা''। বাংলা ভাষা এত কঠিন কেন।
বাবা চোখ থেকে চশমা খুলেছেন। এটা বেশ খারাপ লক্ষণ। তিনি এখন ভাষণ দেবেন। যে ভাষণের মর্মবাণী খুবই সরল। আমাদের মতো গাধাদের উচিত স্কুলে না পড়ে গ্রামে গিয়ে হাল চাষ করা।
বক্তৃতা দেয়া হলো না। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই দেখা গেল, বাবার এক বন্ধু সপরিবারে এসেছেন।
বাবা অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। গরমের দিন বলে খালি গায়ে ছিলেন। তাড়াহুড়ো করে শার্ট খুঁজে পেলেন না। একটা গেঞ্জি কোনো ক্রমে পড়ে উনাদেরকে ভেতরে ডাকলেন, আরে ফরিদ ভাই আসুন, আসুন। ঠিক সেই সময়ে আবিষ্কার হলো, তিনি গেঞ্জি উল্টো করে পড়ে ফেলেছেন। অবশ্য তখন আর ভুল শোধরানোর কোনো সুযোগ নেই।
আম্মুর মুখটা একটু অন্ধকার হলো। তবু ''ভাবী বসুন বলে'', চেয়ার এগিয়ে দিলেন। একটু পর তাকে চায়ের কৌটা আঁচলে ঢেকে পাশের বাসায় যেতে দেখা গেলো। বাসায় চা শেষ হয়ে গিয়েছিলো।
আমরা দুই ভাই অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে পড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। বাসায় কেউ আসলে আবার পড়া কিসের। হায়, এমন করে প্রতিদিন কেন কেউ আসে না। তাহলে আমাদের গ্রামে গিয়ে হাল চাষ করতে যেতে হয় না। আমার ছোট ভাই ফিস ফিস করে আমাকে বলল, দুই প্যাকেট মিষ্টি আনছে রে। এক প্যাকেটে লাল মিষ্টি।
আমার ছোট ভাইয়ের চোখ অত্যন্ত পরিষ্কার। মিষ্টির প্যাকেট ভেদ করে ভেতরের জিনিস স্পষ্ট দেখতে পায়। তার কথা মিথ্যে হবার নয়। আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেলো। আহা। জীবন এত সুন্দর কেন।
অতিথিরা কেবল চা খেয়ে যাবেন, কথা এমনই ছিলো। বাবা বললেন, গরীবের বাসায় দুইটা ডালভাত না খেয়ে যেতেই দেবো না।
অতিথি আঁতকে উঠলেন। কী বলেন এসব, ছি ছি। আরেক দিন এসে ডালভাত না, একদম পোলাও কোর্মা খেয়ে যাবো। হা হা হা।
এসব কথার পাল্টাপাল্টি খেলা। শেষ মুহুর্তে আম্মু কিছু রেধে ফেললেন। ডিমের তরকারি বা চচ্চড়ি। সবাই মিলে মেঝেতে মাদু্র বিছিয়ে খেতে বসলাম। খেতে খেতে জানা গেলো, এক সময় আমরা সবাই অত্যন্ত বড়লোক ছিলাম। তখন পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু ছিল। অতিথি আসলে মুরগি জবাই করা হতো। এখন আর সেই দিন নেই। কচুর লতি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করতে হয়। বাবা এবং বাবার বন্ধু দুইজনই অত্যন্ত বিষন্ন হয়ে গেলেন। তাদের চিন্তিত মুখ দেখে মনে হলো, সুযোগ থাকলে তারা ঢাকা শহরেই গোয়াল ঘর মেইনটেইন করতেন।
বিটিভিতে রাত দশটার খবর শুরু হলো। মানে এখন অনেক রাত। অতিথিরা বিদায় নিলেন। মিষ্টির প্যাকেটগুলো মিটসেফে তুলতে তুলতে আম্মু বললেন, কাল তোরা স্কুলে টিফিন নিয়ে যাস।
একটা সাধারণ দিন হঠাৎ করেই কেমন যেন অন্য রকম হয়ে গেলো।
যারা তিথি মেনে আসেন না, তাদেরকে বলা হয় অ-তিথি। এখান থেকে অতিথি শব্দটি এসেছে।
এক সময় আমাদের বাসায় অতিথি আসতেন।
আমরাও অতিথি হয়ে কারো বাসায় যেতাম।
আজকাল অতিথি প্রথা উঠে গেছে। এখন বাসায় যে বস্তুটা আসে , ওটার নাম গেস্ট। রীতিমতো দিনক্ষণ, খাবারের মেন্যু, এমনকি পানীয় পর্যন্ত পূর্ব নির্ধারিত থাকে। বেড়াতে যাওয়া তো নয়, রীতিমতো পরীক্ষা দিতে যাবার মতো। নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট এদিক, ওদিক হবার জো নেই। সব মিলিয়ে দুই ঘন্টার মাপা সময়।
আমার গেস্ট ভালো লাগে না।
তিথি না মেনে আসা মানুষগুলোই আসল মানুষ।
ছেলেদের এই দুঃখের কথা কয়টা মানুষ জানে?