টিকটিকি দেখলে প্রিয়দর্শিনীর কথা মনে পড়ে। প্রিয়দর্শিনীর কথা ভাবলে বুকের ভেতর কষ্টের তোলপাড় শুরু হয়। তখন আমার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে। আর সিগারেট খেলে প্রচন্ড কাশি হয়। খুক খুক খুক। পুরো ব্যাপারটি ধারাবাহিক। টিকটিকি দর্শন, প্রিয়দর্শিনীর স্মৃতি, বুকের ভেতরে কষ্টের তোলপাড় এবং খুক খুক খুক। টিকটিকিরা সম্ভবত একথা জানে না। জানলে তারা যখন তখন আমার চোখে সামনে আসতো না।
আমি যে ঘরে থাকি সেখানে অনেক টিকটিকি। অবশ্য এটাকে কি ঘর বলা যায়? ছাদের চিলোকোঠা। ইটের চার দেয়ালের মাথায় ঢেউ টিন। মধ্যরাতে কখনো কখনো যখন ঝুম বৃষ্টি নামে, আমি ইটপাথরের চার দেয়ালের ভেতর শুনি নাগরিক বৃষ্টির শব্দ। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। আজ প্রায় অনেকদিন হলো আমি এ ঘরে নির্বাসিত। কিংবা পুনর্বাসিত। আজ থেকে বছর বিশেক আগে যখন এ বাড়িতে আসি তখন এটি ছিল একতলা টিনশেড বাড়ি। মামা বাড়ি। মামার বাড়ি। জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়ে মায়ের সঙ্গে আসা। একদিন মাও চলে গেলো। মায়ের স্মৃতি ক্রমাগত ঝাপসা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মামা শান শওকতে বাড়তে লাগলেন। একতরা বাড়ি ধাই ধাই করে পাঁচতলা হলো। বয়সের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে আমিও জীবনের মধ্যপথে। এক সময় মূল বাড়ি থেকে ছাদের চিলেকোঠায় নির্বাসিত। নির্বাসিত কিংবা পুনর্বাসিত। ছাদের চিলেকোঠায়। আকাশের কাছাকাছি। প্রিয়দর্শিনী মামারই মেয়ে। লম্বায় আমার চেয়ে এক বিঘত ছোট, বয়সে এক বছর। ছাদের চিলেকোঠায়, আকাশের কাছাকাছি বেশ ভালোই ছিলাম আমি। ভেজা ভেজা নক্ষত্রের নিচে। চাঁদের বাঁধ ভাঙা জোয়ার। জ্যোৎ¯œা রাতে বনে যাওয়ার বদলে ছাদময় পায়চারি। ভর দুপুরে সূর্যের প্রত্যক্ষ আদর। তেতে ওঠা ছাদ। টিনের চাল বেয়ে নামা গ্রীষ্মের খরতাপ। একদম চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা। শুয়ে শুয়ে দেয়ালে টিকটিকি দেখা। বিচলনরত। সঙ্গমরত। আমার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। আর কেউ না টিকটিকি।
আমার তেমন নিচে নামা হতো না। কেবল খাওয়ার সময়। রোজ তিনবেলা নামতে হতো আহার্যর জন্য। আর নামা হতো সিগারেট কিনতে একদম নিচে পাড়ার মোড়ের দোকানটায়। মাস শেষে মামার কাছ থেকে কিছু টাকা পেতাম। হাতখরচ বাবদ। মায়ের বেশ কিছু টাকা আর গয়না ছিল মামার কাছে। সেখান থেকে কিছু অনুদান। দু আঙুলের হাড়িকাঠে ধুম শলাকা আর টিকটিকি এবং আকাশের গোটা কয় নক্ষত্র ছাড়া আমি একদম নির্বান্ধব। মাঝে মাঝে ভর দুপুরে উঠে আসতো প্রিয়দর্শিনী।
আজ সেই প্রিয়দর্শিনীর বিয়ে। ছাদের নির্জনতা আর রাতে নেই। অনেক হই হুল্লোড়। হাসাহাসি। পুরো পাঁচতলার গা ছুঁয়ে গয়নার মতো লেপ্টে আছে আলোকসজ্জার ছোট ছোট লাইট। জ্বলছে আর নিভছে। নিভছে আর জ্বলছে। আজ প্রিয়দর্শিনীর বিয়ে।
আকাশের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ে যায় আজ প্রিয়দর্শিনীর বিয়ে। আমার মনে পড়ে ভর দুপুরে মাঝে মাঝে প্রিয়দর্শিনী উঠে আসতো ছাদে। বলতো, চলো আমরা বিয়ে করে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই।
প্রিয়দর্শিনীকে বিয়ে করে সত্যিই দূরে কোথাও পালিয়ে যাওয়া যায় কি না, এ নিয়ে আমি অনেক নির্ঘুম রাতেও স্বপ্ন দেখেছি। বাংলা সিনেমার মতো হিসাব মিলিয়েছি। স্বপ্নে বিভোর হয়ে ভেবেছি জীবনটাকে সত্যি সত্যি বাংলা সিনেমার মতো সাজানো যায় কি না। আমি ওকে নিযে পালিয়ে যাবো। ময়নাদ্বীপের মতো কোথাও। যেখানে এই পাঁচতলা বাড়ি থাকবে না; কিন্তু অবিকল এরকম ছাদের চিলেকোঠা থাকবে। যেখানে মামা থাকবে না কিন্তু মামাতো বোন প্রিয়দর্শিনী থাকবে। হা হা হা।
আজ আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যায় জগতের নিয়ম সরল সমীকরণের মতো নয়। এখানে ছাদের চিলেকোঠা থাকলে, পাঁচতলা বাড়ি থাকবে। পাঁচতলা বাড়ি থাকলে বাড়ির মালিক মামা থাকবেন। মামা থাকলে তার কন্যা প্রিয়দর্শিনী থাকবে। আর প্রিয়দর্শিনী থাকলে এরকম চাঁদজাগা রাতে প্রবল আলোর বন্যায় তার বিয়েও হয়ে যাবে। আবার সেই অর্থহীন ধারাবাহিকতা। চিলেকোঠা, পাঁচতলা বাড়ি, মামা, মামাতো বোন, সানাইয়ের সুর। নিরর্থক ধারাবাহিকতার জীবন। তারপরও মনে পড়ে ভর দুপুরে প্রিয়দর্শিনীর উঠে আসা। অ্যাই জানিস, বিয়ে করাটা খুব সহজ! কেবল তিনবার কবুল বললেই হয়। কোনো কাবিননামা, কাগজপত্র লাগে না।
আমি অবাক হই। বলি, তাই নাকি?
হ্যাঁ। যদি কোনো মেয়ে তোকে বলে আমি তোমার হইলাম। ব্যস তাতেই বিয়ে হয়ে যায়। কোনো কাগজপত্র লাগে না। গাঢ় আত্মবিশ্বাসে প্রিয়দর্শিনী বলে।
ব্যাপারটা চট করে আমার মাথায় ঢুকে যায়, বিয়ে করাটা খুব সহজ। আমি ব্যাকুল হয়ে বলি, অ্যাই বল না, তুই আমাকে বল, আমি তোমার হইলাম।
প্রিয়দর্শিনী গভীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় বলে, আমি তোমার হইলাম। আর ঠিক তক্ষুনি একটা টিকটিকি দেয়াল থেকে টিকটিক করে ডেকে ওঠে। আমার মনে অন্ধভাবে ঢুকে যায়- এই কাকতালীয় ঘটনায় বিয়েটা বোধহয় লেগেই গেলো। ওকে কাছে টেনে নিই। আমি তোমার হইলাম। কি অদ্ভুত শিশুতোষ স্বীকারোক্তি! আমি তোমার হইলাম। টিক টিক টিক। প্রিয়দর্শিনীর ঠোঁটে, চোখে অজ¯্র চুমু এঁকে দিই। আজ প্রিয়দর্শিনীর বিয়ে। শালা বানচোত টিকটিকিরা তোমরা কোথায়? আজ রাতে তোমরা নীরব কেন? হিং¯্র চোখে দেয়ালের দিকে তাকাই।
দুই
এই গল্পের নায়ক সেই রাতেই প্রবল আক্রোমে ঘরের সবকটা টিকটিকি খুঁজে খুঁজে মেরে ফেলে। তার বিয়ের একমাত্র সাক্ষী। আকাশের নক্ষত্র নয়, চিলেকোঠার মূক দেয়াল নয়, মাথার উপরের শব্দহীন টিনের চাল নয়, কাগজপত্র নয়, কেবল টিকটিকি। অথচ এসব তক্ষকের অর্থহীন নীরবতা এই গল্পের নায়কের কাছে প্রবল রহস্যময় মনে হয়। মনে হয় প্রতারণা। কাজেই টিকটিকি বধ করো। এছাড়া কিইবা করার ছিল তার। টিকটিকিজনিত জটিলতা তার মাথায় চেপে বসায় এ ঘটনার কদিন পর, এ গল্পের নায়ক এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। চোখে চমশা এঁটে একদল টিকটিকি কোথায় যেন যাচ্ছে। স্বপ্নের ভেতর চশমা পরা টিকটিকির দলটা জানায়, তারা স্কুলে যাচ্ছে। লেখাপড়া করতে। তাদেরও তো জীবন আছে। বংশ রক্ষার ব্যাপার আছে। গল্পের নায়কের জীবন থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছে। আসলে মুখের কথার কোনো দাম নাই। মুখে কেউ কাউকে এক লাখ বার ‘আমি তোমার হইলাম’ বললেই কেউ কারো হয় না। এ জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট কাগজপত্র। গল্পের নায়ক তার বাস্তব উদাহারণ। স্কুলগামী সেসব টিকটিকি গল্পের নায়কের সাম্প্রতিক বিরহদশা সম্পর্কে গভীর সমবেদনাও প্রকাশ করে।
তিন
ঘুম থেকে উঠেই চোখ খুলে দেয়ালের দিকে তাকাই। শূন্য দেয়ালে একটা টিকটিকিও নেই। ব্যাপার কি? ওরা গেলো কোথায়? ব্যাকুল হয়ে ভাবতে ভাবতে বাথরুমে ঢুকি। আর তক্ষুণি মনে হয় এখন কেবল সকাল নয়। স্কুল আওয়ার। ওরা তো স্কুলে!