আমাদের বসার ঘরে একটা খাট আছে, খুবই পুরান আমলের সিংগেল খাট। এ রকম দুটি খাট দিয়ে আমার বাবা মা সংসার শুরু করেছিলেন। তাদের ত্রিশ বছরের দাম্পত্য জীবনের অনেক স্মৃতি বিজড়িত খাটটির সাম্প্রতিক অবস্থা শোচনীয়। খাটটাতে কেউ বসলে সেটা ভীষণ নড়ে চড়ে। আমার ছোট বোন বিলুর ধারণা, খাটটা বাতাসেও নড়ে। কথাটা অবশ্য ঠিক। ছোট খাট দমকা হাওয়ায় খাটটা যেন একটু দুলে উঠে।
এই খাটটি আমার মার দুচোখের বিষ। তিনি ইতিমধ্যে খাট জোড়ার একটি ভেঙ্গে বারান্দায় ফেলে রেখেছেন। আরেকটি আমার বাবার প্রবল আপত্তির মুখে ভাঙ্গা সম্ভব হয়নি। সেটা ড্রয়িং রুমে পাতা আছে। কোন গেস্ট এলে তাদের মধ্যে কেউ যদি খাটটাতে বসে পড়েন, তবে একটা মজার দৃশ্যের অবতারনা ঘটে। কেউ বসার সাথে সাথে খাটটা দুলে উঠে এবং যিনি খাটে বসেছেন তিনি জীবন রক্ষার সহজাত তাড়নায় সাথে সাথেই লাফিয়ে উঠেন। খাটটার এরকম বিশ্বাস ঘাতকতায় আমার ভাই বোনরা প্রথম লজ্জা পেলেও এখন আর তেমন পাইনা। বরং আমাদের কাছে ব্যাপারটা মজারই মনে হয়। কিন্তু এরকম ঘটনায় মা ভীষণ ক্ষেপে যান। বারবার বলেন, কতবার বলেছি খাটটা বেচে দাও। কেউ শোনেনা আমার কথা। আমি কি মানুষ না অন্যকিছু। চেঁচামেচি করতে করতে তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়। এদিকে খাট যদি সত্যি সত্যিই বিক্রি হয়ে যায়, এরকম একটা আশংকায় আমার বাবার ব্লাড প্রেসার ফল করে। বড় কঠিন সমস্যা।
আমার বাবার যখন বিয়ে ঠিক হয়, তখন তিনি বেকার। ঢাকায় পড়াশুনা করতেন। বিয়ের পর মাকে ঢাকায় নিয়ে আসবেন এমন একটা পরিকল্পনা থেকে তিনি খাট বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু একবারে ডাবল খাট বানানো খুব খরচের ব্যাপার। এজন্য তিনি একটা একটা করে দুই মাসে দুটি খাট বানান। খাট ফেলে দেয়ার প্রসঙ্গ এলেই তিনি এই কাহিনী বলে বসেন। এর সঙ্গে অবশ্য আরও কিছু ফিরিস্তি থাকে। যেমন- খাটটা অরিজিন্যাল সেগুন কাঠের। অনেক ঘুরে ঘুরে তিনি খাটের কাঠগুলো কিনেছেন। খাটটা বানিয়েছিল এক হিন্দু মিস্ত্রী, মিস্ত্রীর নাম আনন্দ সাহা। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
মেয়েরা খানিকটা বোধহয় হৃদয়হীন হয়। তা না হলে মা কেন এই স্মৃতিবিজড়িত খাটটাকে একদমই সহ্য করতে পারে না। শুধু তাই নয়। মিলু, বিলু, আমার দুই বোন। এরাও খাটটা নিয়ে সবসময় হাসি ঠাট্টা করে। খাটটা এদেরও দু চোখের বিষ।
অবশ্য আমি নিজেও খাটটাতে বসিনা, শোয়াতো দূরে থাক। মনে হয় বসলেই খাটটা ভেঙ্গে পড়বে। বাবা অবশ্য প্রায়ই খাটটাতে শুয়ে থাকেন। আশ্চর্য ব্যাপার কখনও কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। তিনি দিব্যি শুয়ে থাকেন। এই নিয়ে মার সাথে একদিন। তার তুমুল ঝগড়া হয়ে গেল। সেই থেকে বাবা ড্রয়িং রুমে সেই ভাঙ্গা খাটেই রাত কাটান। গত দু’মাস ধরে তিনি এই কান্ড করছেন। এতে নাকি তার ঘুম বেশ ভালই হচ্ছে ইদানিং। বারান্দায় ফেলে রাখা খাটটা আবার জোড়া লাগিয়ে ড্রয়িং রুমে পাতবেন কিনা এই নিয়ে তিনি বেশ ভাবনা চিন্তা করছেন। মার ভয়ে জোর দিয়ে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। এরি মাঝে একটা দূর্ঘটনা সত্যি সত্যি ঘটে গেল।
বিলু স্কুল থেকে ফিরছিল। ওর বান্ধবী নিতুর সাথে শেয়ারে রিকশায় ফেরার কথা। কিন্তু নীতু আজ স্কুলে যায়নি। ফেরার রিকশাও ছিলনা। পায়ে হেঁটে বাড়ির গলিতে ঢুকতেই উল্টো দিক থেকে ভীষণ গতিতে একটা গাড়ি এল। বিলু আবার ছোটবেলা থেকেই গাড়িঘোড়া খুব ভয় পায়। গাড়ী দেখে এক দৌড়ে গাড়ী সাইড দিতে গিয়ে পা চলে গেল ম্যানহোলে। এরপর তাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি। অনেক টাকা বেরিয়ে গেল। ডাক্তার বললেন, পায়ে একটা অপারেশন করতে হবে। হাজার দশেক টাকা লাগবে। আমাদের ভীষণ টাকাটানির সংসার। হুট করে হাজার দশেক টাকা জোগাড় করা খুব সহজ কাজ না।
বড় মামা এলেন। তিনি নানান ধরনের ব্যবসা করেন। মা’ই তাকে খবর দিয়ে আনিয়েছেন। মামা এসে ড্রয়িং রুমের সেই ভাঙ্গা খাটে বসলেন। খাটটা যথারীতি দুলে উঠল। মামা ভড়কালেন ঠিকই- কিন্তু লাফিয়ে উঠলেন না। বরং গম্ভীর হয়ে বললেন, বাহ্্ খাটটাতো টিকই আছে। কাঠ মনে হচ্ছে খুব দামী। শুধু পায়া গুলোই দেখছি নড়বড়ে হয়ে গেছে। খাট সম্পর্কে এই প্রথম এত বড় কমপ্লিমেন্ট শুনে বাবা আবেগে একেবার গলে গেলেন। সাথে খাটটার ইতিহাস তিনি আবারও বলে ফেললেন। লাখ টাকা দিলেও এমন খাট আর বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না - এই কথাটাও বলতে ভুললেন না। কাঠের মূল্য আমার ব্যবসায়ী মামা ঠিকই বুঝলেন। ঠিক হল - এই খাট জোড়া তিনি বিক্রি করার ব্যবস্থা করবেন।
হঠাৎ করে খাটজোড়া বিক্রি হয়ে গেল। হাজার দশেক টাকা মামা মা’কে গুনে দিল। ভেবেছিলাম খাট বিক্রি করে মা খুব খুশি হবেন। দেখা গেল, বরং তিনিই বেশি গম্ভীর। বাবাও উচ্চবাচ্য করলেন না। চুপ করে রইলেন। সেই টাকায় বিলুর অপারেশন হল। পায়ের প্লাস্টার নিয়ে বিলু বাসায় ফিরে এল। এ দিকে বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। বাবা এখন অসুস্থ শরীর নিয়ে সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকেন। যে খাটে তিনি শুয়ে থাকেন, সে খাটটা গত বছর কেনা হয়েছিল পান্থপথের ফার্নিচারের দোকান থেকে। সেকেন্ডে হ্যান্ড শিপিংয়ের বক্স খাট। বেশ মজবুত আর শৌখিন খাট। কিন্তু বাবা সেই খাটে শুয়ে সারাদিন উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকেন। রাত্রেও তিনি নাকি ঘুমান না। মার কাছে তাই শুনলাম। একদিন ভোররাতে বাবা মারা গেলেন। তার গ্রামেই তাকে দাফন করা হল।
মাঝে মাঝে আমার ভয়ানক ইচ্ছে হয় মাটি খুড়ে বাবাকে দেখি। কবরে শুয়ে তিনি ঘুমাচ্ছেন নাকি। মাটির বিছানায় তার তো ঘুম হওয়ার কথা না। অরিজিন্যাল সেগুন কাঠের নড়বড়ে খাট যে সেখানে নেই।